বালিকা তোমাকে বলছি, শুনছ।বালিকা তুমি এলোমেলো চুল নিয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে থাক। আমি দেখছি তোমায়,তুমি বলবে কি আমায়?
আমি বলছি শুন, যখন আমার জন্ম তখন আমার এক জেঠাত বোন নাম রেখেছিল আমার ‘স্বপ্ন। সবাই আমাকে স্বপ্ন বলে ডাকত।
ঠিক আমার জন্মের দুই বছর পর আমার সঙ্গী হিসেবে আমার ছোট ভাই জন্ম নেয়।এখন মনে না থাকলে ও হয়তো তখন খুবই খুশি ছিলাম ভাইয়ের জন্মে।
ভাইয়ের নাম রেখেছিল মোহাম্মদ রুবেল। আমি ও বড় হচ্ছি, মা বাবার স্বপ্ন পূরণে আমার ভাই ও ঠিক একটু একটু হাঁটা শিখছে।
আমার বয়স ঠিক চারের কাছাকাছি। আমার ভাইটি আঠারো মাসে পা রাখছে। আমার এখনো মনে আছে প্রতিদিন আমি তার সাথে খেলতাম। সে ছিল আমার খেলার সাথী। দুজনের মাঝে আমি বড় হিসেবে সে আমাকে সবসময় অনুসরণ করত।
একদিন বর্ষার মৌসুমে পুকুরের পানি কানায় কানায়। ঠিক পুকুর পাড় থেকে হাত দিলে পানি ধরা যায়। আমি ও আমার ভাই প্রতি দিনের ন্যায় খেলতেছি।সেদিনের খেলাটি ছিল ভাপা পিঠা বানানো খেলা। পুকুর পাড় থেকে ঠিক একটু দূরে।
আমি ভাপা পিঠা বানানোর জন্য পানি নিলাম।মাটি ছিল কিছুটা বালি মিশানো যা ভাপা পিঠা বানানোর জন্য খুবই উপযুক্ত।
আমি বানানো শুরু করলাম। মা রান্না ঘর থেকে আমাদের দুজনকে দেখে দেখে কচুরলতী থেকে আঁশ উঠাচ্ছে।
আমার ভাপা পিঠা বানানো প্রায় পাঁচটা ছয়টা হল। ঠিক এমন সময় দেখি আমার পিঠে বানানোর জন্য যে পানি নিয়েছিলাম তা শেষ হয়ে গেছে।
তখন আমি মাথা তুলতে দেখি আমার ভাই আমার মতো করে বানাচ্ছে ভাপা পিঠা। সে হাত দিয়ে বানাচ্ছে। দেখি দুই হাত জড়ো করে বানানোর চেষ্টা করছে।মনে হয় আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসছিলাম।সে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। ঠিক তখন আমার যে পিঠা বানানোর জন্য পানি শেষ হয়ে গিয়েছিল।
আমি তখন একটা পাত্র নিয়ে পানি নিয়ে আসি।আমার সিঁড়িতে নামতে হয়নি। পানি ছিল পুকুরের কানায় কানায়। আমি পানি নিয়ে এসে ঠিক আগের মতো পিঠা বানানো শুরু করলাম।
খানিক পরে বাবা ব্যবসার কাজে টেকনাফ যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল। বাবার কেন জানি যেতে ইচ্ছে করেনি।গাড়িতে না উঠে আবার ঘরে ফিরে আসে। এসে আমাকে খেলতে দেখে মা থেকে জিজ্ঞেস করল, রুবেল কয়? মা তখন বলে কেন স্বপ্ন এর সাথে খেলতেছে। তখন আমার ও কানে আসে রুবেল কয়।
বাবাআমার থেকে জিজ্ঞেস করতে আমি বলি এখানে ছিল।
তখন আমার খেলা বন্ধ আমি ও খুঁজতে থাকি।সারা বাড়ি খুঁজে না পেয়ে, পুকুরে এসে খুঁজতে লাগল। পুকুরের পানি কেমন জানি স্থির। পানি গুলো একটু ছোট ছোট ঢেউ খাচ্ছে। তখন মনে হয় আমার ভাই পুকুরের মাটি অবধি চলে গিয়েছিল। সবার সন্দেহ হয় পুকুরে। পুকুরে নেমে পড়লো আমার চাচা। আমরা উকিল চাচা বলে ডাকি।
আমার চাচা ডুব দিয়ে উঠতে দেখি, আমার চাচার দুই হাত দিয়ে লম্বা করে ধরে আমার ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে আসছে।তখন আমার চোখে পড়ল যেই পাত্র দিয়ে পানি এনে ছিলাম সেই পাত্র পুকুরে ভাসছে।
এখন( আমার মনে হয়, আমি যখন পানি এনেছি আমার ভাই ও পানি আনতে গিয়েছিল।)
আমার চাচা মাথার উপর করে আমার ভাইকে হাসপাতাল নিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর নিয়ে আসল। আমি তখনো জানি না আমার ভাই যে মারা গেছে। এদিকে দেখি আমার মা শুধু কাঁদছে। আমার বাবা মাকে বকা দিচ্ছে আর খানিক পর পর মাকে মারতে যায়। চাচারা মারতে দেনা।
কিছু সময় পর দেখি ভাই উঠে আর বসে না।ভাইকে দেখি কয়েকজন মিলে কলা গাছের উপর শুয়ে দিয়ে গোসল করাচ্ছে।
তারপর দেখি সাদা কাপড়ে তাকে জড়িয়ে ফেলছে। বাঁশ দিয়ে একটা চারকোনা করে, দুই ফুট করে কঞ্চি বানাল। ওখানে ভাইকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই কান্না করতেছে। আমি ও মনে হয় কান্না করতেছি। আমি ও ভাইয়ের সাথে সাথে গেলাম। সবাই টুপি পড়ে গেল। আমি দাড়িয়ে আছি। মসজিদের হুজুর জানাজা পড়ল।আমি সব দাড়িয়ে দেখে থাকলাম।
নামাজের পরে দেখি আমার ভাইকে কবর দেওয়া হচ্ছে। ঠিক তখন যে কবর দেওয়া দেখলাম। আমার ভাইয়ের উপর মাটি দেওয়া হচ্ছে দেখলাম। সেই তখন থেকে আমি কিছু সময়ের জন্য এখনো স্হির হয়ে পড়ি।
আমি এখনো দেখি আমার ভাইকে কবর দেওয়া হচ্ছে। মাটি দেওয়া হচ্ছে। আমি এখনো খুঁজি আমার ভাইকে। যে কিনা আমার ছোট বেলায় খেলার সাথী ছিল। আমি তাকে খুঁজতে খুঁজতে, যখন আমি বড় হই।আমার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হই।আমার প্রথম যোগদান হই, তুতুরবিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। আমার চাকরির সুবাদে আমি স্কুলে যেতাম আমার ভাইয়ের কবরের পাশ দিয়ে। কাকতালীয় ভাবে কেন জানি আমার স্কুলে যেতে হয় ভাইয়ের কবরের পাশ দিয়ে।মনে মনে ভাবি স্কুলটা এই দিকে হয়ে ভালোই হয়েছে ।প্রতিদিন
যাওয়ার পথে, খানিক সময় দাঁড়াতাম । কবরের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতাম। মনে মনে ভাবতাম আজ আমার ভাই থাকলে হয়তো পরিবারের সম্পদ হতো।
তখন থেকে আজ অবধি ভুলতে পারি না ভাইকে।জীবনে কাউকে আর খেলার সাথী করিনি। আমি এখনো খুঁজি আমার খেলার সাথী ভাইকে।
আল্লাহ আমার ভাইকে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান বানিয়ে রাখুক। আমিন।
লেখক
শারমিন আকতার
সহকারী শিক্ষক