আব্দুস সালাম,টেকনাফ
কক্সবাজারের টেকনাফের কাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পাহাড়সম অভিযোগ। হোয়াইক্যং ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ডে অবস্থিত বিদ্যালয়টি। ২০১৭ সালে এ বিদ্যালয়ে
যোগদান করেন প্রধান শিক্ষক কুতুব উদ্দিন।
অভিযোগ রয়েছে তখন থেকে অদ্যবধি বিদ্যালয়টি নিরব দূর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। যেনো বিদ্যালয়টি তাঁর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান । তাঁর ইচ্ছে মাফিক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালিত হয়।
সরেজমিন খোঁজ খবর নিয়ে জানা গেছে, সূচনালগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠানটি ভালই চলছিল।
এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। ওই প্রধান শিক্ষকের কারণে এমন বেহলা অবস্থা। অধিকাংশ নারী শিক্ষক বিদ্যালয়ে ২-৫ দিন অনুপস্থিত থাকলেও রহস্যজনকভাবে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষরিত হয়ে থাকে। আবার অনেক ক্ষেত্রে কয়েকজন শিক্ষক ৫ দিন না এসেও ৬ দিনের মাথায় এসে সব স্বাক্ষর করে দায় সারেন। অনুপস্থিত শিক্ষকের কাছ থেকে মাসোহারার ভিত্তিতে তাদের স্বাক্ষর নিজে বা অন্য কারো ধারা হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করানো হয় এমন বিস্তর অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি ৫ম শ্রেণী উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিদায় অনুষ্ঠানের নামে ৩শত টাকা উত্তোলন করে। স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতির চাপে কিছু শিক্ষার্থীদের টাকা ফেরত দেওয়া হলেও অনেক শিক্ষার্থীদের টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি। শুধু তা নয়, তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে প্রতি বছর, বই বিতরণ-ভর্তি বাণিজ্য করে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। প্রতিবছর ডিসেম্বর জানুয়ারী ভর্তি ও বই প্রদানের নামে শ্রেণীভেদে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫০/১০০ টাকা করে তোলা হয়। করোনাকালীন সময়ে স্কুল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও এসব টাকা আদায় করেছিলেন তিনি। ৬০০/৭০০জন শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রতিবছর প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক টাকা যায় তার পকেটে।
২০১৯ সালে বনভোজনের নামে প্রতি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৫০ টাকা করে আদায় করলেও অদ্যবধি কোনো ভোজনের দেখা পাননি শিক্ষার্থীরা। এসব টাকার হিসেব কোথাও যোগ হয়না।
এরই মধ্যে স্কুল পরিচালনা কমিটি না থাকায় বেপরোয়াভাবে তিনি যেনতেনভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা করেন। পরে নির্বাচনের মাধ্যমে স্কুল কমিটি গঠন করায় তার বেপরোয়া খানিকটা কমে আসলেও স্কুল কমিটিকে ফাঁকি দিয়ে এসব অপকর্ম করেই যাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তুলে অভিভাক ও স্কুল পরিচালানা কমিটির অনেকে।
সম্প্রতি এমন একটি অনিয়ম ও অপরাধ করে আরও আলোচনা ও সমালোচনার মাত্রা বাড়িয়ে দেন এই প্রধান শিক্ষক কুতুব উদ্দিন। তাঁর ছেলে হোসনে মুবারক তাহমিন সদ্য অনুষ্ঠিত চতুর্থ শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় পরপর ৩টি পরীক্ষায় অনুপস্থিত থেকে সকল বিষয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ৫ম শ্রেনীতে প্রথম ও সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হওয়ার সংবাদে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
গত ৮-১৯ ডিসেম্বর ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত ও সম্পন্ন হয়। এরমধ্যে ওই ছাত্র ৮, ১১ ও ১২ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠিত বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত থেকেও শ্রেণী ও বিদ্যালয়ের প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রধান শিক্ষক ১৩ ডিসেম্বরে তার ছেলেকে বিদ্যালয়ে এনে রাতে অফিস কক্ষে গোপনে পরীক্ষা নেন। অতি গোপনে তৈরী করা হয় বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলও। এসব ফলাফল প্রকাশ না করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের একেকজন করে বলা হয় রোল নাম্বার।
গত ২৫ জানুয়ারি তারিখে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির পক্ষে প্রতিটি শ্রেনীর রোল ১,২,৩ এ উত্তীর্ণ মেধাবীদের সনদপত্র প্রদান করে তার স্থিরচিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ৫ম শ্রেণির অভিভাবকদের মধ্যে কৌতুহল সৃষ্টি হয়। তার অনিয়ম ও দূর্নীতির কারণে অনেক অভিভাবক তাদের শিক্ষার্থীকে অন্য স্কুলে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
৫ম শ্রেণীর এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক হাসিনা আক্তার জানান, প্রধান শিক্ষকের ছেলে অনিয়মিত একজন ছাত্র। বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত থেকে স্কুল ফার্স্ট হওয়া পুরো এলাকার জন্য লজ্জাজনক। বিষয়টি অন্যান্য শিক্ষার্থীদের নিশ্চয় হতাশ করে।
অভিভাবক আব্দুর রহিম বলেন, বিদায়ী অনুষ্ঠানের কথা বলে টাকা তোলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। এই অভিভাবকের প্রশ্ন এই টাকা কী সরকার তুলতে বলেছেন? নিয়মিত স্কুলে শিক্ষক উপস্থিত থাকেন না, বই বিতরণ ও ভর্তি বাণিজ্য বিষয়ে অভিযোগ করেন শিক্ষার্থী অভিভাবক ও স্কুল পরিচালনা কমিটির লোকজন। এমন কী, খোদ ওই স্কুলের শিক্ষক ও নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এমন স্কুল বাংলাদেশে আর আছে কী না সন্দেহ। স্কুল প্রধানের দূর্নীতি ও অনিয়মে বিদ্যালয়টি তলানিতে পৌঁছে। তার ছেলেকে অনিয়মভাবে ২য় শ্রেনী থেকে উত্তীর্ণ করে ৫ম শ্রেণীতে তুলেছেন। অথচ আমরা শিক্ষক হয়ে কোনোদিন দেখিনি স্কুলে এসে তার ছেলের পাঠদান করতে। সেই সাথে এমনও সময় গেছে, নারী শিক্ষিকার সাথে গল্পগুজবে মেতে থেকে ক্লাস না করে বাড়ি চলে যান তারা। কতিপয় শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেও রহস্যজনকভাবে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর হয়ে যায়। এছাড়া সপ্তাহে ৫ দিন না এসে ৬ দিনের মাথায় সব স্বাক্ষর করানোর সুযোগ দেন ওই প্রধান শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে আরও ভুরি ভুরি অভিযোগ রযেছে বলেও জানান তিনি।
কাটাখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সহ-সভাপতি মো. আবু তাহের বলেন, শিক্ষকপুত্রকে তিনটির বেশি অনুপস্থিত থেকে প্রথম স্থান অর্জন করানো, শিক্ষকগণের অনুপস্থিতি ও টাকা নেওয়ার নানা অভিযোগ আমাদের নিকট করেছেন অনেক অভিভাবক। টাকা নেওয়ার বিষয়টি আমরা এসএমসি সভায় বলেছিলাম। এ দায় স্কুল পরিচালনা কমিটি নিবেনা।
তিনি আরো বলেন,শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও স্কুল পরিচালনা কমিটির লোকজনই বলছে পাহাড়সম অনিয়ম ও দূর্নীতি করে বহাল তবিয়তে থাকতে পারেন না। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান তিনি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কুতুব উদ্দিন বলেন, ‘আমর ব্যাপারে আনিত সকল অভিযোগ মিথ্যা ও সাজানো। কেউ অনুপস্থিত থাকলে এসব ধরার দায়িত্ব আমার’ বলেও জানান তিনি।
টেকনাফ উপজেলা প্রাথমিক সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা (এটিও) আশীষ বোস বলেন, কিছু অভিযোগ স্কুল সভাপতি করলেও কিছু অভিযোগ তার অজানা। তিনি বাকি অভিযোগ খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেন। তিনি যে সব অভিযোগ পেয়েছেন, এরই প্রেক্ষিতে স্কুল প্রধানকে শোকজ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।