কিশোরী বয়সে একটু ভাবুক ছিলাম, টুকিটাকি লেখালেখি করার চেষ্টা করতাম। একজন মা একটা সন্তান প্রসবের সময় যেমন যন্ত্রনা ভোগ করে, একটা সময় ছিল যখন আমি লেখার জন্য সেই অনুভূতি অনুভব করতাম। কত সময়ে লেখাটি শেষ হবে। আমি খুব ভালো লিখতাম তা না। তবে লেখার জন্য টান ছিল সব সময়। তাই লেখার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গা বেছে নিতাম।
একদিন আব্বাকে বললাম: চন্দ্রিমা উদ্যানে যাবো সেখানে বসে একটা কবিতা লিখব।আব্বা বললেন: একা যাওয়া যাবে না আমি তোমাকে নিয়ে যাব। আমি তো কোনো কারণেই রাজি না, আব্বার সাথে চন্দ্রিমা উদ্যানে যাওয়ার জন্য। আব্বা বললেন: আমি দূরে বসে থাকবো, তুমি তোমার মতো করে লিখ কেউ বুঝতে পারবে না যে তোমার সাথে তোমার আব্বা আছেন।আর কোন উপায় নেই দেখে আব্বার সাথেই যেতে হলো।
আমার লেখার চেয়ে ভাব ছিল একটু বেশি। আব্বা ছিলেন আমার ভালো বন্ধু, আমার যে কোন বিষয় – তাকে জানাতাম। আব্বার সাথে প্রায়ই কথোপকথন হতো, জীবনের বিশেষ দু একটি ঘটনা ছাড়া আর সবই তাকে বলতাম। আব্বা চাইতেন তার সন্তান যেন ভুল পথে না যায়। লেখার জন্য বাবা মেয়ে রওনা দিলাম মতিঝিল থেকে চন্দ্রিমা উদ্যানের উদ্দেশ্যে। আমি তখন কবিদের মত একটি ব্যাগও ঝুলিয়ে নিলাম। তখন ব্যাগটি আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। চন্দ্রিমা উদ্যানে পৌঁছাতেই আব্বা বললেন: যাও তুমি ওইখানে বসে লেখালেখি শুরু করো।তারপর আমি একটি গাছের নিচে বসতেই একটার পর একটা ছেলে কাছে আসে, আর নিজে নিজে বির বির করে বলে একা নাকি? আসবো নাকি? লেখার জন্য আমার যে ভাবছিল তা মুহূর্তের মধ্যেই বিরক্তিতে পরিণত হলো। তারপর একটু একটু করে আব্বার কাছে আসলাম। আব্বা বুঝতে পারলেন যে এই পরিবেশ আমার জন্য নয়। সেই সময় আমাদের দেশের পার্কগুলো এত উন্নত ছিল না। অনেক অনিরাপদ ছিল পার্ক গুলো। তাই সন্তান ভুল করতে পারে কিন্তু বাবা-মা ভুল করতে পারেন না। তাই আমাকে একা পার্কে ছাড়েননি আমার আব্বা। আমাকে মেয়ের মত করে মানুষ করেন নাই, আব্বা সব সময় বলতেন আমি তার ছেলে, তার সন্তান। আমার আব্বা সব সময় আমাকে সাহায্য করতেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। আব্বা কখনো রাগ করতেন না আমার উপর। জীবনে একবার রাগ করেছিলেন, যার জন্য আব্বা মেয়ে কথা বলিনি এক বছর। শেষমেষ আমার রাগেরই জয় হল, এরই সাথে শেষ হল আমার জীবনের অনিশ্চয়তার অধ্যায় । অন্য কখনও সময় পেলে বলবো সে রাগের কারণ। তার পর আব্বা খুব শান্ত সুরে বললেন তোমার লেখা শেষ? আমি বললাম: না।
আব্বা বললেন কেন? আমি বললাম: ছেলে গুলো বিরক্ত করছে। এখানে লেখা হবে না, চলো বাসায় যাই। বাসায় যেতেই মা রাগ করে বললেন: মেয়ে যা বলবে সবই কি শুনতে হবে? আব্বা বললেন: মেয়ে বড় হচ্ছে, মেয়েকে সময় দিতে হবে, তা না হলে ভুল পথে ভুল মানুষের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। মা শাসন করতেন আর্মির মত, সবকিছুতে সময় বেঁধে দিতেন, এমনকি বান্ধবী নির্বাচনেও মায়ের সিদ্ধান্ত ছিল অটল। যে বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যেত, তাদের সাথে সম্পর্ক রাখতে দিতেন না। যদি খুব জেদ করতাম তখন মা বলতেন, যখন তোমার বিয়ে হবে তখন তাদের সাথে মিশো, এখন মিশা যাবেনা। সেই সময় মা আমাকে স্কুলে/কলেজে নিয়ে যেতেন। মা অনেক শাসন করতেন বলে আব্বা মাকে বলতেন: রসি বেশি টাইট করে বাঁধলে ছিড়ে যাবে, আবার লুজ করে বাঁদলে মাথায় বাড়ি খাবে। তাই কিছুটা স্বাধীনতা দেওয়ার পক্ষে ছিলেন আব্বা। আমাকে নিয়ে প্রায়ই ঝগড়া হতো আব্বা আর মায়ের মধ্যে। আব্বা অফিসে থাকা অবস্থায় যদি মা আমকে বকা দিতেন? প্রতিশোধ নেয়ার জন্য আব্বা অফিস থেকে আসার সময় কান্না শুরু করতাম। আর আব্বা এসে মাকে বকা দিতেন। আমার বিয়ের ৬ মাস পর আব্বা মারা যান। আব্বা মারা যাওয়ার ২২ বছর পর মা মারা যান। আব্বা মারা যাওয়ার পরে অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাকে। অনেক আপন আত্মীয়দের দূরে সরে যেতে দেখেছি। আব্বা বেঁচে থাকতে বাসায় দাদার/নানার বাড়ির আত্মীয় স্বজনের মিলনমেলা হতো। হঠাৎ করে তাদের দূরে সরে যাওয়াটা আমাকে অনেক বেশি চিন্তিত করে দিল। আব্বা মারা যাওয়ার ৪০ দিন পর্যন্ত তার জুতো বুকে নিয়ে ঘুমাতাম। বাসায় রান্না বন্ধ ছিল। বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবার আসতো। আব্বা মারা যাওয়ার পরে তিনটি জানাজা হয়। সেই সময় অনেক বড় এবং ছোট কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেকেই এসেছেন। সবাই বলতেন একজন ভালো মানুষ ছিলেন। জানাজা শেষে অনেক কান্না করছিলাম। তখন এক চাচা (আব্বার অফিসের কলিক ছিলেন), আমাকে বললেন: মা কান্না করো না। তুমি যদি সত্যি তোমার আব্বাকে ভালোবেসে থাকলে, তার থাক তবে তার পছন্দের কাজগুলো করবে, তার ভালোবাসার মানুষদের ভালবাসবে, আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর রাখবে, তবেই তোমার আব্বার আত্মা শান্তি পাবে। ঠিক তখন মনে হল আমার মা আর তিন ভাই বোনের কথা। আব্বা আমাদের অনেক ভালোবাসতেন। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছিলাম কিন্তু আমাদের সুখ ছিল রাজপ্রাসাদের মত। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আব্বার অপছন্দের কোন কাজ করবো না এবং পরিবারকে কষ্ট পেতে দিব না। চেষ্টা করেছি আগলে রাখতে। তখন আর্মির মত শাসন করা মা আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে যান। মা হার্টের রোগী ছিলেন, মারা যান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে। মা মারা যাওয়ার এক বছর আগে বলতেন স্বামী মারা যাওয়ার ২২ বছর হয়ে গেছে বুঝতে পারেনি তর জন্য। মারা যাওয়ার আগে মা শিশুদের মত হয়ে গেছিলেন। কক্সবাজার থেকে যখন বাসায় ফিরতাম তখন মায়ের রুমে মা অপেক্ষা করতেন আমি মায়ের রুমে আগে যাব। আর অন্যদিকে ইসফার আমার রুমে অপেক্ষা করতো তার রুমে আগে যাব। মায়ের রুম আর আমার রুম পাশাপাশি তাই মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুজনকে ভালেবেসে আমি ইসফারকে কোলে নিয়ে দুজনকে একসাথে জড়িয়ে ধরতাম। তখন দুজনই খুশি হয়ে যেত।
লেখক:জেসমিন প্রেমা
চেয়ারম্যান স্কাস