আবদুর রহিম শাওন।
সকাল ৮ঃ৪৫মি।পূর্বের দিনের মতোই দবির সাহেব(প্রধান শিক্ষকের ছদ্ম নাম)স্কুলে গিয়ে দেখতে পেলেন কোন দুষ্ট ছেলে-পেলে বাথ রুমের কমোটের উপর পায়খানা করে রেখে গেছে!দবির সাহেবের স্কুলে দপ্তরী বা নৈশ প্রহরী নেই।তাই তিনি কিছুক্ষণ চিল্লা -ফাল্লা করার পর আশপাশ টা দেখে নিয়ে নিজেই ব্রাশ আর বদনা হাতে পরিষ্কারের কাজে নেমে পড়লেন!এ সময় স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন পথচারী কাশেম।তিনি কতটুকু পথ যাবার পর স্কুল অভিমুখে আসা ২য় পথচারী করিম(তিনি দীর্ঘ দিন বিদেশ থাকার পর দেশে এসেছেন সে কারণে বর্তমান প্রধান শিক্ষকের সাথে করিমের পরিচয় নেই)!করিম জিজ্ঞেসা করলেন”কাশেমের কাছে, আমার তো,একটা ছাড় পত্র দরকার।স্কুলে কি প্রধান শিক্ষককে দেখেছেন?”১ম পথচারী কাশেম বললেন”স্কুলে সুইপার ছাড়া আর কাউকে দেখিনি!তারপরেও তিনি স্কুলের দিকে এসে দেখলেন।ততক্ষণে দবির সাহেব দরজা জানালা খুলছিলেন,পতাকা উত্তোলন করছেন।ন’টায় ঘন্টার ধ্বনী দিচ্ছিলেন।করিম এসে বললেন,”স্কুলে তো দপ্তরী ছাড়া আর কেউ নেই মনে হয়?”দবির সাহেব বিরক্ত হয়ে,নিজের পরিচয় না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন”কি জন্য?করিম বললেন-আমার ছেলে রাকিব তো,চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে-তাকে আমরা শহরে ওর নানা বাড়িতে রেখে পড়াতে চাই।সে জন্য একটা ছাড় পত্র লাগবে।ওহ্,আসেন-বলে দবির সাহেব লিখে দিয়ে,বললেন এই নিন।করিম সাহেব চলে যাবার সময় মুরব্বী গোছরের একজন লোক স্কুল অভিমূখে আসছিলেন,তিনি করিম কে জিজ্ঞাসা করলেন,বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক সাহেব কি এসেছেন?করিম বললেন”তিনি এখনো আসেন নি,কেরানি হবেন মনে হয়!তার কাছ থেকেই ছাড় পত্রটি নিয়ে চলে এলাম।ক্লাস শুরু হয়েছে।শিক্ষকগণ ক্লাস নিচ্ছেন।দবির সাহেব শ্রেণি পর্যবেক্ষণ করছেন।মাঝে মাঝে বেঞ্চের নিচে এখানে সেখানে পড়ে থাকা কাগজের টুকরা কুঁড়াচ্ছেন।ক্লাসে ডুকে বেঞ্চগুলো সাঁজিয়ে দিচ্ছেন।।মুরব্বি এসেই হাঁক দিলেন-হেডস্যার কি আছে?ততক্ষণে দবির সাহেব মুচকি হেসে বলছেন,”জি আমি।।আমি ৯নং ওয়ার্ড থেকে এসেছি।আপনি নাকি ভোটার হাল নাগাদের সুপারভাইজারের দায়িত্ব আছেন?আমার এক নাতিকে ভোটার করাতে হবে।প্রয়োজনীয় কাগজ কী কী লাগবে একটু জানতে আসলাম?দবির সাহেব সবিস্তারে বললেন।হট পট দিয়ে চা করে খাওয়ালেন।তিনি প্রধান শিক্ষককে ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন।বিকাল-৪ঃ১৫ মিঃ দবির সাহেব ছুটির ঘন্টা বাজিয়ে স্কুলে কিছু উন্নয়নের কাজ চলছে সে গুলো দেখে নিজের চেয়ারে বসতে যাবেন এমন সময় উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে কল আসলো,উপবৃত্তির সার্ভার খোলে দেয়া হয়েছে।আজ রাতের মধ্যেই সকল চাহিদা আপলোড দিতে হবে!চলছে কর্মযজ্ঞ।বিজলীর বাতি জ্বালিয়ে চলছে চাহিদা আপলোড প্রদানের কাজ।এই যা!কারেন্ট চলে গেলো!স্কুলের ল্যাপটপ টা দীর্ঘদিনের পুরোনো।ব্যাটারি কারেন্ট ধরে রাখতে পারে না।সন্ধ্যা সাতটা।দবির সাহেবের বাসা থেকে ফোন এলো ছোট মেয়েটার ঠান্ডা লেগেছে।ডাক্তার দেখানো দরকার।দবির সাহেব সরাসরি বলে দিলেন কাল সকালে ছাড়া সম্ভব না।বিদ্যুৎ আবার এলো,দবির সাহেব কাজে মনোনিবেশ করলেন।৪৯৬জন শিক্ষার্থী।মাঝে মাঝে স্কুলের জানালার পাশে একটা হুতোম প্যাঁচা ডেকে যাচ্ছে।রাত ১১টা।নিচে কেউ মৃদু স্বরে বলছে,”স্কুলে তো নৈশঃপ্রহরী নেই?এতো রাতে স্কুলে কে!চাহিদা আপলোড দেয়া শেষ হলো,ক্ষুধার্ত বেগে বাড়ি আসলেন।দবির সাহেবের স্ত্রী রাগে অগ্নীশর্মা।এক গাঁদা বকুনির ফাঁকে বলতে লাগলেন!ওম,চাকুরি যেনো তিনি একা করনে?সবাই স্কুল থেকে চলে এসেছেন বিকাল চারটায় আর তিনি আসলেন, রাত এগারো টায়!অসহায় দবির সাহেব,নিরব।মনে মনে ভাবছেন,উচ্চ আদালতের রায় টা কার্যকর হলেই ১০ম গ্রেড বাস্তবায়ন হবে।তখন আর এতো অভাব হযত থাকবে না।গত ২১ বছর ধরে প্রমোশনে প্রধান শিক্ষক হবার কারণে একটা টাইম স্কেলও পায়নি।১০ বছর পূর্তিতে উচ্চতর স্কেল পাবার যে স্বপ্ন ছিলো তাও,তৃতীয় শ্রেণি আর ২য়শ্রেণির জটিলতায় ২৪ সালের আগে হচ্ছেনা!দবির সাহেবের ব্যাচমেট আর তিন বছর পরে যোগদান করা শিক্ষকও দবির সাহেবের চেয়ে বেশি এবং সমান বেতন পান।হয়ত পৃথিবীর অনেক দেশের মতো কোন দিন এই শিক্ষকতার চাকুরি প্রথম শ্রেণির চাকুরির মর্যদা লাভ করবে!কিন্তু ততদিন দবির সাহেব অবসরে থাকবেন অথবা দুনিয়াতেও থাকবেন না!এই দবির সাহেবের জন্য সমবেদনা।ভাল থাকুন দেশের হাজার হাজার দবির সাহেবরা।এই কামনায় সমাপ্তী।বিঃদ্রঃকাউকে অপমান,ছোট কিংবা আঘাত করার জন্য এলেখা নয়।কিছু সত্য আর কিছু গল্পের সংমিশ্রনে এলেখা।সহকারি শিক্ষকগণ প্রধান শিক্ষকগণের যোগ্য উত্তরসূরী।দুইয়ের সহযোগিতায় রচিত হউক আগামির বাংলাদেশ।
লেখক-আবদুর রহিম শাওন
প্রধান শিক্ষক
তুমব্রু(প্রাক্-প্রাথমিক-অষ্টম শ্রেণি)সরকারি প্রা.বি।
শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক/২২ বান্দরবান জেলা।