মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম: মানব পাচার যাকে আদম ব্যবসা নামে অভিহিত করি| আমরা অনেকেই এর সঠিক সংজ্ঞা সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকি বহাল নই। সঠিকভাবে বলতে গেলে মানব পাচার হচ্ছে দেশের সীমানার ভেতরে ও বাইরে কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে বল প্রয়োগ করা, প্রলুব্ধ করা, প্ররোচিত করা, অপহরণ করা এবং কোন সহিংসতার আশ্রয় নিয়ে ঐ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে স্থানান্তর করা, চালান করা, লুকিয়ে রাখার মাধ্যমে বিক্রয়, বিনিময় বা অন্য কোন বে-আইনি কাজে নিয়োজিত করা ইত্যাদি এবং এসবের সাথে সম্পৃক্ত সব ধরনের কর্মকান্ড (মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২)। সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল প্রকার জবরদস্তি শ্রম এবং অনুচ্ছেদ ১৮ অনুযায়ী পতিতাবৃত্তিরোধ এবং দমন রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং অনুচ্ছেদ (২৭-৪৪) এ বেশ কয়েকটি মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সে কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্র মানবপাচার প্রতিরোধও প্রতিকারে দায়বদ্ধ।
এখানে জেনে রাখা ভাল, SDG তিনটি লক্ষ্য সরাসরি মানব পাচার দমন এবং প্রতিরোধের সাথে সংশ্লিষ্ট¨।
অভীষ্ট-৫ অর্থাৎ জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন
খ। অভীষ্ট-৮ অর্থাৎ সকলের জন্য পূর্ণও উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান এবং সহনশীল কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং টেকসই অর্ন্তভূক্তিমূলক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন
গ। অভীষ্ট-১৬ উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অর্ন্তভূক্তিমূলক সমাজ ব্যবস্থা তৈরী, সকলের জন্য ন্যায় বিচার প্রাপ্তির পথ তৈরী করা এবং সকল পর্যায়ে কার্যকর জবাবদিহিমূলক ও অর্ন্তভূক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গঠন।
উল্লেখ্যযে,SDG বাস্তবায়ন কর্ম পরিকল্পনাকে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সংগে সামঞ্জস্য রেখে জাতীয় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (২০১৮-২০২২) সমন্বিতভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে।
গত২৫জুন২০২০খ্রি.তারিখ আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত বৈশ্বিকTrafficking In Person (TIP)প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান Tier 2 watch তালিকা হতে Tier 2তে উন্নীত হয়েছে। এ অবস্থায় উন্নীত হওয়ার কারণ হচ্ছে মানব পাচার প্রতিরোধে বিভাগীয় জেলা ও মহানগরের জন্য ৭টি ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং অসাধু রিক্রুটিং এজেন্সীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারকে অর্ভ্যথনা জানালেও আরো অনেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আছে বলে মন্তব্য করা হয়। উল্লেখ্য, মানব পাচার সংক্রান্ত একটি চমৎকার ও কার্যকরী আইন হল মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ যেখানে একই সাথে অপরাধ ও বিচার পদ্ধতির বিস্তারিত বিধান আছে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে জাতীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি রয়েছে। তাছাড়া, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক সভাপতি/ প্রবাসী কল্যাণ কর্মকর্তা সদস্য সচিব, উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও সভাপতি/উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সদস্যসচিব এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে চেয়ারম্যান সভাপতি/ইউপি সচিবকে সদস্য সচিব করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। যাদের দায়িত্ব মূলত নিয়মিত বৈঠক করাসহ সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনি সহায়তা প্রদান ও সার্ভাইভর পুর্নবাসন/নিরাপত্তাবিধান প্রভৃতি।
বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তহতে সাধারণ নিরীহ লোকদের ফ্রি ভিসা বা কোনো প্রকার শ্রম চুক্তিপত্র ছাড়াই ভালো চাকরি, বিয়ের সুযোগ নানান সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে বিশেষ করে মালয়েশিয়ায় ট্রলারে করে সমুদ্র পথে এবং মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সৌদি আরব , লেবানন, বাহরাইন প্রভৃতি দেশে পাঠানো হয়। এ প্রসঙ্গে টেকনাফে বর্তমানে আউটসোর্সিং এ চাকরিরত একজন চালক ভুক্তভোগীর করুণ বক্তব্য শেয়ার করলাম। তাহলো টেকনাফ সাবরাং এর খুরেরমুখ হতে চাকরির আশায় বেশ কয়েকটি ট্রলার পরিবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় তিন মাস উন্মুক্ত আকাশের নিচে রোদ, বৃষ্টি সয়ে খুব সামান্য জায়গায় হাঁটুগেড়ে বসে গিয়েছিলাম। পাটেনে বসার সুযোগ পর্যন্ত ছিলনা এবং মাঝে মাঝে পা জোড়া অবশ হয়ে যেত। চোখের সামনে মা-বোনের উপর অনেক নির্যাতন দেখেছি। আমাকে জিম্মি করে পরিবার হতে টাকা আদায় করা হয়েছিল। তিন মাসে প্রতিদিন একবেলা রুটি আর সামান্য সেদ্ধ আলু ছাড়া কিছু খেতে দেয়নি। প্রথমে যখন মালয়েশিয়ায় গিয়ে ভাত পেলাম, তখন খুব ক্ষুধায় খেতে খেতে আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ে যাই এবং আমাকে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়েছিল। কেউ যাতে আমার মতো ভুল করে এপথে পা নাবাড়ায়।
তবে যতই সচেতনতামূলক প্রচারণা হোকনা কেন জীবিকার মান উন্নয়ন ব্যতীত মানবপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।। এ লক্ষ্যে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে যেমন-মৎস্য চাষ, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগী পালন, গবাদি পশু হৃষ্টপুষ্ট করণ, ভ্রাম্যমান কম্পিউটার প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ঋণ প্রদান করছে। উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষা অর্জনে সহায়তা করছে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বয়স্ক ভাতা, বিধবা বা স্বামী নিগৃহীত ভাতা এবং অসচ্ছল শনাক্তকৃত প্রতিবন্ধী ভাতাসহ অন্যান্য ভাতা দেয়া হচ্ছে। ভিজিডি আওতায় দুঃস্থ, অসহায় ও হত-দরিদ্র, স্বামী পরিত্যাক্তা এবং বিধবা মহিলাদের প্রতিমাসে পুষ্টি সমৃদ্ধ চাল বিতরণ ছাড়াও আয় বর্ধনমূলক প্রশিক্ষণসহ ভাতা প্রদান করা হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প আমার বাড়ি আমার খামার এর সমিতির মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে সাধারণ ঋণ দেয়া হচ্ছে যাতে সমাজের কেউ পিছিয়ে না পড়ে। তাছাড়া, ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। যেগুলো সার্বিকভাবে নিঃসন্দেহে মানব পাচার হতে রক্ষা পেতে অবদান রাখছে।
তবে মানবপাচার প্রতিরোধে ও দমনে জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস আরো শক্তিশালী করা জরুরি। সকল পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জনবল বৃদ্ধিসহ, যানবাহন সংখ্যা এবং বিশেষ করে কোস্টগার্ডের টহল বোট সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। তদুপরি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের মানবপাচার বিষয়ক কর্মশালার মাধ্যমে প্রশিক্ষিতকরা গেলে মূল্যবান ভূমিকা পালন করবে। যেসকল পথে/ পয়েন্ট গুলো দিয়ে সাগর পথে মানব পাচার হওয়ার আশংকা থাকে সে সকল জায়গা গুলো আলোকিত করে সিসিটিভির আওতায় আনা যেতে পারে। মানব পাচার বিষয়ক নিয়মিত সভা এবং এতে সংশ্লিষ্ট সকলের আরো কার্যকরী অংশ গ্রহণ দরকার। মানব পাচার চক্রান্তে জড়িতদের ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনালের জনবল ও বাড়ানো প্রয়োজন।
জাতীয়ভাবে বিভিন্ন দেশ ও আর্ন্তজাতিক সংস্থাস মূহের সাথে যোগাযোগ, চুক্তি সম্পাদন ও সমন্বয়ের মাধ্যমে উপযোগী নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান করা সময়ের দাবী। এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অবস্থান আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করতে পারে। তাছাড়া অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ বৃদ্ধিসহ ন্যূনতম ৫০টিরও বেশি দেশে শ্রম কল্যাণ উইং (যা বর্তমানে ৩০টি মাত্র) চালু করা গেলে প্রবাসে সরকারি সেবার মান বাড়ার পাশাপাশি মানব পাচার হ্রাস ও রেমিটেন্স অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর বাংলাদেশ ১৪ থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রবাসী আয়/রেমিটেন্স পাচ্ছে যা দেশের ভাবমূর্তি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এ প্রসঙ্গে নির্বাচনী ইশতেহারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার প্রতিবছর প্রতি উপজেলা হতে ১০০০জন দক্ষ নাগরিক বৈধভাবে অভিবাসন। জনসংখ্যার চাপ কমাতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি একটি সুদূর প্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি বটে এবং তা বাস্তবায়নে উপজেলা পর্যায়ে আগ্রহীদের ডাটাবেস করে বিশ্ব চাহিদা মোতাবেক সরকারি–বেসরকারি সংস্থার সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরীর মাধ্যমে বৈধভাবে বিদেশ গমনের লক্ষ্যে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এভাবেই আমরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত পূর্বক মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারি।
মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম
উপজেলা নির্বাহী অফিসার
টেকনাফ, কক্সবাজার
ইমেইল[email protected]